নানান ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে দেশে বিদেশি ভাষার প্রচার ও প্রসারে ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়। এক বছরের মাথায় আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা সম্পন্ন হতে না হতেই, ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে এক রক্তাক্ত ঘটনার মাধ্যমে দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটে। এই রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলশ্রুতিতে দেশে বিদেশি ভাষা শিক্ষার আদর্শবাহী রাজনৈতিক শক্তির পতন ঘটে।
পরিণতিতে তখন দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়, প্রতিক্রিয়াশীল ডানপন্থী সরকার। দেশে প্রতিষ্ঠিত সেই নতুন সরকার বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ থেকে সরে আসে। পরিণতিতে দেশে বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্যোগ ভেস্তে যায়। ফলশ্রুতিতে আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের কার্যক্রম রাষ্ট্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অলক্ষ্যে চলে যায়। সে সময় যুগপৎভাবে ইংরেজি ভাষিক সাম্রাজ্যবাদের তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। এই তৎপরতার ফলে দেশে একটি ইংরেজি ভাষিক সামাজ্যবাদের প্রতিভূ শক্তি বিকশিত হতে থাকে।
এই শক্তি শিক্ষাব্যবস্থার নানাস্থানে প্রভাব বিভাবে ব্যপৃত হয়। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালস্থ আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট হয় এই শক্তির জন্য উপযুক্ত বিচরণ ক্ষেত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়স্থ আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট যেখানে হওয়ার কথা ছিলো বিদেশি ভাষা শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম বিকাশের প্রতিষ্ঠান, সেখানে এই প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠে ইংরেজি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট বা অনুরূপ নামের প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি ভাষাজ্ঞান শুন্য উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদেরকে নির্দিষ্ট মেয়াদ অন্তর শিক্ষা সমাপন শেষে সনদ হিসাবে জুনিয়র সার্টিফিকেট, সিনিয়র সার্টিফিকেট, ডিপ্লোমা ও উচ্চতর ডিপ্লোমা সনদ প্রদান করা হয়।
বিদেশি ভাষায় সনদ প্রদানের এই শিক্ষা কার্যক্রমের কাঠামোটিকে ব্যবহার করে ১২ বছর কাল ইংরেজি ভাষায় শিক্ষা লাভকারী উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদেরকেও ইংরেজিতে এই জুনিয়র সার্টিফিকেট, সিনিয়র সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়। অথচ ভাষাগত দক্ষতা ধাপ (Level of Proficiency) মানদণ্ডে উক্ত ইংরেজি শিক্ষা কার্যক্রম অযৌক্তিক, অনৈতিক ও স্থুল বুদ্ধি প্রসূত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়স্থ আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে বর্তমানে ইংরেজি ভাষা বনাম বিদেশি ভাষা নিয়ে একটি বাহাস চলছে।
এই বাহাসটির কেন্দ্রীয় প্রশ্ন হলো- বাংলাদেশের ভাষা- পরিস্থিতিতে ইংরেজি কী একটি বিদেশি ভাষা না-কি দ্বিতীয় ভাষা। এর একটি প্রায় গ্রহণযোগ্য উত্তর থাকলেও, ইংরেজি শিক্ষাবিদরা কখনও বলছেন এটি একটি বিদেশি ভাষা, আবার কখনওবা বলছেন এটি বাংলা ভাষার বিকল্প। ইংরেজি শিক্ষাবিদদের বক্তব্য যাই থাকুক না কেনো, ইংরেজি ভাষার প্রতিভূ শক্তির একটি মহাউদ্যোগ জনগণের কাছে স্পষ্ট হয়েছে। সেটি হলো এ শক্তিটি চায়-বাংলাদেশের সমস্ত সরকারি-বেসরকারি বাণিজ্যিক, সমাজকল্যাণমূলক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেনো ইংরেজি ভাষা মাধ্যমে চলে। তাঁরা স্পষ্টতই দেশের রাজনৈতিক শক্তির অংশ। তাঁদের ইংরেজি ভাষা সম্পর্কিত অভিলাষ ও রাজনৈতিক কর্তৃত্বের কৌশলকে কাজে লাগিয়ে ইংরেজি ভাষাকে বাংলা ভাষা ও বিদেশি ভাষার উপর মর্যাদা আরোপ করে, এটিকে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে।
ইতোমধ্যে তাঁরা শিক্ষানীতি থেকে মাতৃভাষা বাংলা ও বিদেশি ভাষা শিক্ষার বিষয়টিকে অপসারণ করেছেন, যেনো মাতৃভাষা বাংলা শিক্ষা কার্যক্রমকে ব্যহত করা যায়। অন্যদিকে তাঁরা বিদেশি ভাষা শিক্ষা সম্পর্কিত বিষয়টিকে অপসারণ করেছেন, যেনো দেশে ইংরেজি ভাষার প্রতিদ্বন্দ্বী ও পরিপূরক না থাকে। তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো দেশের সব মানুষকে ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থার আওতায় এনে, ২/৩ কোটি মানুষকে বাঙ্গালি থেকে বাংলিশ জাতিতে রূপান্তর করা। তাঁদের এই চূড়ান্ত লক্ষ্য বাস্তবায়িত হলে দেশে কার্যত বাঙ্গালি জাতির মধ্যে বাংলিশ নামের একটি উপজাতির সৃষ্টি হবে, যারা দেশের জনগণের চেয়ে সংখ্যায় কম হবে; কিন্তু বাঙ্গালি জাতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে।
এভাবে বাঙ্গালি জাতি ও বাংলিশ জাতি-এই দুই জাতির মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিভেদের দেয়াল তৈরি হবে। দেশে উন্মেষ ঘটবে নতুন দ্বি-জাতি তত্ত্বের। এই বিভেদের দেওয়ালের একদিকে থাকবে বাঙ্গালি শোষিত শ্রেণি ও অন্যদিকে থাকবে বাংলিশ শোষক জাতি।
উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে, ইংরেজি ভাষা মাতৃভাষা বাংলা ও বিদেশি ভাষা- এই উভয় ধরণের ভাষার উপরই আধিপত্যবাদী ভাষা হিসাবে অবতীর্ণ হয়েছে। কাজেই ইংরেজি ভাষা এই দুই ধরণের ভাষা বিনাশী ভাষা। একই কারণে বলা যায় যে, ইংরেজি ভাষা সমস্ত বিদেশি ভাষার উপর বিরুদ্ধ ভাষা হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে।
বাংলাদেশের ভাষা-পরিস্থিতিতে ইংরেজি ভাষা কোনমতেই বিদেশি ভাষার সহযোগী ভাষা নয় বরং এটি বাংলা ভাষার বিকল্প ভাষা। সে অর্থে বাংলাদেশের ভাষা পরিস্থিতিতে এটি একটি দ্বিতীয় ভাষা। কাজেই ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে গৃহীত শিক্ষানীতির দোহাই দিয়ে ইংরেজিকে বিদেশি ভাষার সহযোগী ভাষা বলে আখ্যায়িত করার কোনও যৌক্তিকতা নেই। কাজেই বিদেশি ভাষা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি ভাষার সহঅবস্থানের বিষয়টি গ্রহণযোগা নয়। কারণ যে ভাষা বিদেশি নয়, সে ভাষাকে বিদেশি ভাষা হিসাবে গছিয়ে দিয়ে প্রতিষ্ঠান চালাতে গেলে, সেই প্রতিষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা যাবে না।
বিদেশি ভাষার সাথে ইংরেজি ভাষার চাষ হলো, মুরগীর সাথে শিয়ালের চাষের মতো। সেজন্য ইংরেজি ভাষা যুক্ত আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। এই বিষয়টি জানিয়ে ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন বরাবর চিঠি দিয়েছি এবং পত্র-পত্রিকায়ও লেখালেখি করে যাচ্ছি। কিন্তু কোন সুরাহা মিলছে না। অধিকন্তু ইংরেজি শিক্ষকরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের বিদেশি শিক্ষা কার্যক্রমে জেঁকে বসে উক্ত অযৌক্তিক ইংরেজি শিক্ষা কার্যক্রম চালু রেখেছে। তাঁরা মানছে না কোনো যুক্তি, উপদেশ, সূত্র ও বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব।
এ সম্পর্কে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও খারাপ। এক সময় সিলেট বিভাগে অবস্থিত এক বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিউটের বোর্ড অব গভর্ণরসের সদস্য হিসাবে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট থেকে ইংরেজি ভাষা মুক্তির এক কৌশলপত্র জমা দিয়েছিলাম, যে কারণে বোর্ড অব গভর্ণরসের সভায় যাতে না যোগ দিতে পারি, সেজন্য ঐ আধুনিক ভাষা ইনস্টিউটের পরিচালক নানা কলাকৌশলের প্রয়োগ করা শুরু করে, যেমন- সভা শেষ হওয়ার বহু পরে চিঠি দেওয়া ও ফোন না ধরা ইত্যাদি। তারপর থেকে ১টি সভায়ও যোগ দেওয়া সম্ভব হয়নি।
কিন্তু দেশে ইংরেজি ভাষার মর্যাদা পরিবর্তিত হয়েছে। এ দেশের জনগণের পক্ষে এটি এখন দ্বিতীয় ভাষা এবং দেশের মানুষের ১টি অংশের প্রথম ভাষা হলো ইংরেজি ভাষা। কাজেই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে অবস্থিত আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থাকে সংস্কার ও উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি রূপকল্প নির্মাণ করা প্রয়োজন, যেনো আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটকে ইংরেজি ভাষা মুক্ত বিদেশি ভাষা শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তোলা যায়।
ড. এ বি এম রেজাউল করিম ফকির: লেখক, অধ্যাপক, জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ পরিচালক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; ভূতপূর্ব অতিথি শিক্ষক, টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়; ভূতপূর্ব গবেষণা ফেলো, জাপান রাষ্ট্রভাষা ইনস্টিটিউট।