২ জুলাই- এক শিক্ষকের  সোনালী  অধ্যায়ের অবসান—বিদায় মোফাচ্ছের হোসাইন (জীবন) স্যার


ঢাকার চোখ প্রকাশের সময় : জুলাই ৩, ২০২৫, ১১:৩৮ পূর্বাহ্ন
২ জুলাই- এক শিক্ষকের  সোনালী  অধ্যায়ের অবসান—বিদায় মোফাচ্ছের হোসাইন (জীবন) স্যার

শিক্ষকতা শুধু পেশা নয়,এটি একটি মহৎ সাধনা এবং মানুষ গড়ার কারিগর,আর সেই সাধনার দীপ্ত প্রতীক মোফাচ্ছের হোসাইন( জীবন) সরকারি ইস্পাহানী ডিগ্রি কলেজের ইসলামের ইতিহাস  ও সংস্কৃতি বিভাগের  প্রতিষ্ঠাতা,বিভাগীয় প্রধান এবং সহকারী অধ্যাপক মোফাচ্ছের হোসাইন গত 2 রা জুলাই ২০২৫ তারিখে অবসরে যান। তাঁর শিক্ষকতা জীবনের শেষ কর্ম দিবসটি ছিল সকল শিক্ষার্থী, সহকর্মী এবং কলেজ পরিবারের পক্ষ থেকে সম্মান, শ্রদ্ধা ভালোবাসা ও বিদায়ী  অনুভূতিপূর্ণ আবেগে ভরপুর।

৩৩ বছরের শিক্ষকতা জীবনে সততা, নিষ্ঠা, কর্তব‍্যপরায়ণতা, আদর্শিক চেতনার বলিষ্ঠতার পথ ধরে যিনি গড়েছেন হাজার শত শত শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ—তাঁকে শুধু শিক্ষক নয়, এক একজন মুল‍্যবোধের জলজ‍্যান্ত মূর্তপ্রতীক! সর্বপোরী তাকে দিকনির্দেশক বলেই মনে করেন তাঁর প্রিয় ছাত্ররা।

শিক্ষা ও গৌরবময় কর্মজীবনের ইতিহাস

মোফাচ্ছের হোসাইন ১৯৬৬ সালের ১ জুলাই নোয়াখালীর হাতিয়ায় এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা বীর মুক্তিযোদ্ধা  মৌলভি আলতাফ হোসাইন  (নিজাম) ও মাতা মাহফুজা খাতুন। পিতাও 37 বছর এই পেশায় বরন‍্যে শিক্ষক ছিলেন। এসএসসি তে প্রথম বিভাগ ও এইচ এস সি দ্বিতীয় বিভাগে  কুমিল্লা বোর্ড থেকে যথাক্রমে  মাধ‍্যমিক ১৯৮১ ও  উচ্চ মাধ‍্যমিক ১৯৮৩ সালে সমাপ্ত করেন। এরপর চট্টগ্রাম  বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এ (সম্মান) ও এম.এ (ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি) বিভাগ থেকে যথাক্রমে দ্বিতীয় শ্রেণিতে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকার করেন।

পিতার পদাংক অনুসরণ করে ১৯৯২ সালে বিক্রমপুর আদর্শ কলেজে প্রথম প্রভাষক পদে শিক্ষকতা শুরু করেন। অতপর 01লা সেপ্টেম্বর  ১৯৯৪ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৩১ বছর সরকারি ইস্পাহানী ডিগ্রি কলেজে শিক্ষকতা করেন, যার মধ্যে শেষ ৭  বছর সরকারি ভাবে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে এবং ১৩ বছর বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

প্রশিক্ষণ, প্রশাসন ও সংগঠনে দক্ষ নেতৃত্ব

তিনি ছিলেন শিক্ষক প্রশিক্ষণ,মডারেটর, প্রশাসনিক দায়িত্ব ও একাডেমিক উন্নয়নে একজন নির্ভরযোগ্য ও সুদক্ষ ব্যক্তি।  বেসরকারিভাবে  জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশিক্ষণ, HSTTI, ঢাকা শিক্ষাবোর্ড ,কুমিল্লা বোর্ড সহ নানান দেশি-বিদেশি একাধিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। ছিলেন একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য সচিব, স্টাফ কাউন্সিলের  শিক্ষক প্রতিনিধি (১৫ বছর), কলেজ ম্যাগাজিন সম্পাদক, কোর্স কো-অর্ডিনেটর এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষক ও প্রধান পরীক্ষক।

একই সঙ্গে তিনি ছিলেন বেসরকারী শিক্ষক কর্মচারী কল‍্যাণ ট্রাষ্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের  ট্রাষ্টি মেম্বার (২০১৬-১৮), বাংলাদেশ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির (বাকবিশিস) সহ-সভাপতি, সরকারি কলেজ শিক্ষক সমিতির নির্বাহী সভাপতি এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদের আজীবন সদস্য।

শিক্ষক, লেখক ও বুদ্ধিজীবী ব্যক্তিত্ব

শিক্ষার পাশাপাশি গবেষণা ও লেখা লেখিতে তিনি পারদর্শিতা রাখেন।  আল-কোরআনের সংখ্যাতাত্ত্বিক রহস্য এবং ইউরোপে মুসলিম সম্প্রদায় শীর্ষক প্রবন্ধ প্রকাশ পেয়েছে কলেজ বার্ষিকীতে।
শিক্ষা, নেতৃত্ব, মানবিকতা ও চিন্তার সমন্বয়ে গড়া এই শিক্ষক ছিলেন শিক্ষার্থীদের প্রেরণার উৎস।

শ্রদ্ধা ও অশ্রুসিক্ত  ভালোবাসায় বিদায়!

২ জুলাই কলেজের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চোখের জল ও শ্রদ্ধা ভালোবাসা মিশিয়ে অনুষ্ঠান স্হল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সবার কণ্ঠে ছিল একই কথা—“স্যার, আপনি ছিলেন আমাদের শিক্ষকতা জীবনের আদর্শ স্তম্ভ।”

সরকারি ইস্পাহানী ডিগ্রি কলেজের সুযোগ‍্য অধ্যক্ষ প্রফেসর রওশন আরা বেগম বলেন,
“স্যার শুধু শিক্ষক নন, তিনি ছিলেন একজন নিবেদিত অনুকরণীয়  দিক নির্দেশক, সংগঠক ও সত্যিকারের আলোকবর্তিকা। কলেজ তার অবদানের কথা চিরকাল মনে রাখবে।”

শেষ দিনে শিক্ষার্থীদের চোখে নীরব শ্রদ্ধা

তার বিদায়ের দিনে শিক্ষার্থীদের চোখে ছিল নীরব শ্রদ্ধা। একজন শিক্ষকের প্রস্থান যেমন দুঃখের, তেমনি তা শিক্ষা দেয় মূল্যবোধ, দায়িত্ববোধ  এবং নিবেদনের চিরন্তন সত‍্য।
কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর রওশন আরা বেগম বলেন, জীবন স্যার ছিলেন এমন একজন মানুষ, যার আদর্শ ও নৈতিকতা আমাদের সবার জন্য অনুকরণীয়। কলেজের ইতিহাসে তাঁর অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

মোফাচ্ছের হোসাইন স্যারের দীর্ঘ কর্মজীবনের সততা ও ত্যাগ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য হয়ে থাকবে এক অনন্য অনুপ্রেরণা।

লিখেছেন:
শামসুল ইসলাম সনেট
কবি,সাংবাদিক ও উপন্যাসিক