করোনাভাইরাস মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখতে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে গিয়েছিলেন ৬৩ বছর বয়সী অণুজীব বিজ্ঞানী ইয়েন কোয়াক-ইয়েন। চলতি বছরের জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে হংকংয়ের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে উহান শহর ঘুরে দেখেছেন।
অভিজ্ঞ এই বিজ্ঞানী উহান শহরের হাসপাতাল থেকে শুরু করে বন্যপ্রাণী বিক্রির হাট ঘুরে দেখে আসার পর অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন। সেখানে যা শুনেছেন, দেখেছেন এবং বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে স্থানীয় কর্মকর্তারা কী ধরনের আচরণ করছেন, সেসব ব্যাপারেও মুখ খুলেছেন তিনি।
আরও পড়ুন: করোনায় অক্রান্ত এক বাংলাদেশি আইসিইউতে
জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনের (এনএইচসি) সহায়তায় সেখানে যাওয়া গবেষকদলের মধ্যে সার্স গবেষক ঝং ন্যানশান এবং চীনের সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোলের প্রধান জর্জ গাও ছিলেন। এই দল সেখান থেকে ফিরে যাওয়ার পর জানিয়েছে, এক কোটি ১০ লাখ মানুষ সেখানে অবরুদ্ধ হয়ে আছে।
বিজ্ঞানী ইয়েন মনে করেন, বিভিন্ন স্থানে মানুষের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে করোনাভাইরাস। একইভাবে বন্যপ্রাণীর মাধ্যমেও করোনা ছড়াচ্ছে। স্ট্রেইটস টাইমসের সাংবাদিক তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। এখানে তা তুলে ধরা হলো-
প্রশ্ন: আপনি উহানে কী দেখলেন?
ইয়েন: আমার কাছে যা সত্য মনে হয়েছে, তা বলছি। আমরা উহানে যে জায়গাগুলো ঘুরেছি, সেসব দেখে মনে হয়েছে- তারা আমাদের বেশি বেশি দেখাচ্ছিল (প্রদর্শনীর মতো)। আমরা কোনো কিছু জানতে চাইলে তারা সুচিন্তিতভাবে উত্তর দিয়েছে। সেসব শুনে মনে হয়েছে, তারা কঠোর প্রস্তুতি নিয়েছে। তবে ঝং ন্যানশান এসব ব্যাপারে আরো পারদর্শী। এ ধরনের কিছু ঘটলেই উনি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে প্রশ্ন করছিলেন। প্রশ্নগুলো এমন- এখানে আর কিছু ঘটেছে? আপনি যা বলছেন, ঘটনাগুলো কি সে রকমই?
১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত তারা বলছিল, তারা তখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে। চাপের মুখে তারা স্বীকার করেছে হুবেই প্রভিনশিয়াল সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন সেন্টারে ১৪ জন মেডিকেলের কর্মী আক্রান্ত হয়েছেন। তবে তারা বারবার বলছিল, তাদের স্টাফ আক্রান্ত হয়েছে কিনা, সেটা এখনো পরীক্ষা করা হয়নি।
প্রশ্ন: তারা কারা? যখন আপনাদের দল উহান হসপিটালে গেল, সেখানে কারা ছিল?
ইয়েন: উহান মিউনিসিপ্যাল হেলথ কমিশনের কর্মকর্তারা ছিলেন। উহান সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোলের কর্মকর্তা এবং উহানের স্থানীয় হাসপাতালের কর্মকর্তারাও ছিলেন।
প্রশ্ন: আপনার কি মনে হয়েছে, তারা কিছু লুকাচ্ছে?
ইয়েন: আমরা যখন খাবার খাচ্ছিলাম, আমি খেয়াল করে দেখলাম উহানের ডেপুটি মেয়র একেবারে গম্ভীর হয়ে পাশের টেবিলে বসে আছেন।
উহান থেকে বেইজিং ফিরে আপনারা কর্তৃপক্ষকে কী জানালেন?
আমরা ডেপুটি লেভেলের জাতীয় পর্যায়ের নেতা এবং ন্যাশনাল হেলথ কমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বললাম। তাদের সঙ্গে খোলামেলা আলাপ হয়েছে। আমাদের বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। মানুষের মধ্যে এটি ছড়িয়ে পড়ছে এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা অবিলম্বে নেওয়া দরকার।
এর আগে ২০০৭ সালে আমি সার্স নিয়ে গবেষণার ফল প্রকাশ করেছি। ওই সময়ই আমি বলেছি, বাদুড় নানা রকমের করোনাভাইরাস বহন করে। এমনকি চীনে বন্যপ্রাণী না খাওয়ার ফলে পরবর্তী সময়ে বড় ধরনের সংক্রমণ ঘটার ব্যাপারে সতর্ক করেছিলাম।
প্রশ্ন: তার মানে উহান অবরুদ্ধ করে রাখার ব্যাপারে মত দেওয়া বিশেষজ্ঞদের আপনি একজন?
ইয়েন: আমাদের বিশেষজ্ঞ দলের একজন এই মত দিয়েছেন। তিনিই বলেছেন, উহান অবরুদ্ধ করে রাখা উচিত। তিনি অত্যন্ত পেশাদার ব্যক্তি। মহামারী-সংক্রান্ত বিদ্যায় অত্যন্ত ভালো মানের বিজ্ঞানী।
প্রশ্ন: আপনি কি চীনের বন্যপ্রাণী বিক্রির বাজারে গেছেন?
ইয়েন: ওই বাজার ততক্ষণে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। আমরা কয়েকজন গাড়িতে চড়ে সেখানে গিয়েছিলাম। আমরা বাজারটির চারপাশ ঘুরে দেখেছি। সেখানে একজন এসে জানালেন, আমরা গাড়ি থেকে নামলেও আর কিছু দেখতে পাবো না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এর আগে বাজারটি কেমন ছিল। একজন বলল, খুবই নোংরা; আবর্জনা আর ইঁদুরে ভরা। একেবারেই খারাপ পরিবেশ যাকে বলে। অথচ, বিশাল বাণিজ্যিক এলাকার পাশেই ওই বাজার।
প্রসঙ্গত, হংকং ইউনিভার্সিটির এই অধ্যাপক ২০০৩ সালে সার্স ভাইরাসের গতিপ্রকৃতি নির্ণয় করে একে মোকাবিলার উপায় বাতলে দিয়ে খ্যাতি পেয়েছেন। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় হংকংয়ে যে চারজন বিশেষজ্ঞদল গঠন করা হয়েছে, তারও সদস্য তিনি।